মালেক ইকবাল।।
মানালি তে মে, জুন, ডিসেম্বর আর জানুয়ারি মাসে দৈনিক ৫৫০ জন দম্পতিরা আসে মধুচন্দ্রিমার জন্য। আর বাকি সময় আসে ৩৫০ জন দম্পতি। তবে আমাদের উদ্দেশ্য এরকম কিছু নয়। শীতকালীন ক্যাম্পেইন। গ্রুপে ১৪ জন আছি। মানালির বিয়াস নদীর উপত্যকায় মাঝারি সাইজের পাহাড়ে তাবু ফেলেছি। পাহাড়টি সরু লেক থেকে ১০৩ মিটার দূরে অবস্থিত।

সারা দিনের কাজ শেষে সবাই এক সাথে গোল হয়ে বসেছি। মাঝখানে কয়েকটা কাঠে আগুন জ্বলছে। তবুও হাড় কাপানো শীত। চারিদিকে আধো আধো অন্ধকার। সবার গায়ে ইংল্যান্ডের আলখেল্লা টাইপের কোট। হাতমোজা আর কানটুপি। আলোচনার ১২ মিনিট ৪৫ সেকেন্ড যেতেই আমার এক প্রশ্নে সবাই থমকে গেল। ম্যাম আমাকে বলেই ফেললেন- তুমি কি ঠিক আছো? উত্তরে বললাম- জি ম্যাম, কিছুটা। কিন্ত ম্যাম, আপনি কি জানতে পারবেন, আমাদের মধ্যে কে নরওয়ের এভার মার্টিন ব্রান্ডের Laila Perfume ব্যবহার করেছে? এটা শুনতেই সবাই বলে উঠলো, না, আমরা কেউ এই পারফিউমের নামই শুনি নাই।

পাশেই অন্য দেশের একদল আমাদের মতো ক্যাম্পেইনে এসেছে। হলদু রঙের ৯/১০ টা তাবুতে কয়েক জন থাকে। সেখানে গিয়ে আমি একই প্রশ্ন করলাম। উত্তরে একজন বলে উঠলো – হুম, আমার বান্ধবী এভার মার্টিন ব্যবহার করে। ও তো এখানে নেই। পাশের ছোট লেকের কিনারে আছে। আমি হাটতে শুরু করলাম। পথ চিনতে সমস্যা হয় নি। ওই পারফিউমের ফ্লেবারে চারিদিক মুহমুহ। লেকের দিকে যেতেই সেই পারফিউমের হালকা মিস্টি গন্ধে আমি ব্যকুল।

সেই মেয়েটা লেকের পাশে ছোট পাথরের সিড়ির ওপর বসে আছে। অপলক দৃষ্টিতে পানির স্রোতের অনূকুলে তাকিয়ে কী যেন খুঁজতে ছিল? আমাকে দেখে মুখের কোণে এক চিলতে হাসি। গায়ে কালো রঙের উপর সাদা বিন্দুর একটা ড্রেস। এই শীতের মধ্যে কানটুপি তো দুরের কথা একটা শীতের ভারী পোশাকও নেই। পায়ে নুপুর অথবা পায়েল থাকতে পারতো, সেটাও নেই। চুলগুলো খোলা এবং তিন দিকে এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে। দূর থেকে ছোট্ট তিলটা তেমন দেখা যাচ্ছে না। দেখে মনে হচ্ছে আজাদ কাশ্মীরী তথা পাকিস্তানি মেয়ে। স্বচ্ছ স্রোতমুখী সাদা পানির ফেনা চাঁদের আলোয় ডায়মন্ডের মতো ঝলমল করছে। মনে হচ্ছে চাঁদের সম্পূর্ণ আলো তার উপর। অন্য দিকে পানির স্রোতের কুলকুল শব্দ আর ঝি ঝি পোকার মৃদু ধ্বনি।
ঢালু পাহাড়ি রাস্তায় নিচে নামতেই আমার পায়ের সাথে পাথরে হালকা শব্দ হলো। হঠাৎ চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকালেন। আমাকে দেখে ভয়ে কি যেন বলতে চাইলেন। কাপা কাপা কন্ঠ স্তব্ধ হয়ে গেল। কিছু না ভেবে প্রশ্ন করলাম- আচ্ছা, আপনি কি এভার মার্টিন পারফিউম ইউজ করেন? অবাক হয়ে বিস্ময়ের সাথে বললেন- জি, করি। নরওয়ের টা। কিন্তু, কেন, বলুন তো? উত্তর দিতে পারলাম না। টানাটানা হরিনী চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম – আচ্ছা, এই সময় এখানে একা একা বসে কি করছেন? সহজ সরল ভাষায় উত্তর দিলেন- তেমন কিছু না, আমার ভ্যানিটি ব্যাগটা হাত থেকে পরে গেছে। ওই যে পানির মধ্যে ছোট পাথরের সাথে আটকে আছে। আর ওই ব্যাগের মধ্যেই এভার মার্টিন পারফিউম আছে।
এটা শুনে মনটা অজানা কারণে বড্ড খারাপ হয়ে গেল। পানিতে নামার চেষ্টা করতেই বললেন- আরে, এই, কি করেন এই প্রচন্ড শীতের মধ্যে! আর আপনার প্যান্ট তো ভিজে যাবে। পাথরের ওপর হাটু সমান পানি। সেন্ডেল খুলে দুই পা পাথরের উপর রাখতেই সমস্ত শরীরে শীতের কারেন্ট চলতে লাগলো।প্যান্টের নিচের অংশ বাম হাত দিয়ে ভাজ দিয়ে উপরে উঠানোর চেষ্টা করলাম।পারলাম না, ডান হাতের ব্যান্ডেজের কারণে।
এটা দেখে উনি আমার সামনে এসে বসলেন। আমার চোখের দিকে চেয়ে রইলেন। কিছু না বললেও বুঝতে পারলেন যে আমার আপত্তি নেই। তারপর প্যান্ট ভাজ দিয়ে উপরে তুলে দিতে লাগলেন। তার হাতের স্পর্শ আমার পায়ে লাগতেই পা সড়িয়ে নিলাম। কিছুটা অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে বললেন- সরি, আমি খেয়াল করিনি। আপনার পায়ের গোড়ালির স্কিন তো থেতলে গেছে। কিভাবে এমন হলো? এক্সিডেন্টে করেছেন বুঝি! কোন উত্তর দিলাম না। একটু নিচে হয়ে তার হাত দুটো সড়িয়ে দিলাম। পানিতে নামতেই ডান পা পিছলে গেলো। হঠাৎ করে বাম হাত টা ধরে চোখের ইশারায় বললেন- ওই, যে, ব্যাগটা সামনে। ছোট পাথরের সাথে আটকে আছে। পাথরের ওপর কিছুটা স্থির হয়ে দাড়িয়ে বাম হাতে গাছের একটা ডাল নিলাম। ব্যাগের হাতলের মধ্যে ডালটা দিয়ে বারবার ব্যাগটা কাছে আনার চেষ্টা করলাম। হঠাৎ পানির প্রবল স্রোতের এক ঝাপটায় ব্যাগটি পাথর থেকে খুলে নিচে চলে গেল।
লেখক – প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।