মালেক ইকবাল।।
দিন গড়িয়ে বিকেল। কিছুক্ষণ পরেই সূর্য ছুটি নিবে। সূর্যের রক্তিম আভা চারিদিকে ছড়িয়ে আছে। বিলের পানির ছোট ছোট ঢেউ এর সাথে সূর্য রশ্মি খেলা করছে। বিলের কিনার দিয়ে কলার গাছের সাড়ি। আবার কিছু ঝোপ ঝাড়। মাঝে মাঝে সরু রাস্তা। কিনারে কয়েকটা কলার ভেলা আর ডিঙি নৌকা বাধা আছে। একজন বারবার কলার ভেলায় উঠার চেষ্টা করছেন। দেখে বুঝতে পারলাম কলার ভেলায় উঠার অভিজ্ঞতা নেই। আমাকে দেখে অবাক হয়ে বললেন – আরে আপনি এখানে! কী মনে করে এই পদ্ম বিলে আসলেন? আর আপনি কি ব্লু লোটাস হোটেলেই আছেন? উত্তরে বললাম- আরে বাবা, এক সাথে এত প্রশ্ন! কোনটার আগে উত্তর দিবো? সরি বলতেই বললাম- হুম, ওখানেই আছি। তেমন কিছু না, একটু ঘুরতে আসছি, এই আর কি! আপনি কেন আসছেন?

খুবই কমল কন্ঠে বললেন – এই পদ্ম বিলে নাকি লাল পদ্মের মাঝে মাঝে নীল পদ্ম পাওয়া যায়! উত্তরে বললাম -হুম, আমি দেখি নাই, তবে শুনেছি, বিলের একদম মাঝখানে পাওয়া যায়। কিন্তু খুবই কম। গভীর আবেগ নিয়ে বললেন- প্লিজ, আপনি, না বলবেন না, চলুন না? আমাকে একটু সাহায্য করুন। আমার ৭ টা আসল নীল পদ্ম খুবই দরকার। কাগজের বানানো ১০০ টা নীল পদ্ম আমার কাছে আছে।
কোন কথা না বাড়িয়ে দু জন একটা ছোট ডিঙি নৌকায় উঠলাম। উনি নৌকার সামনে বসে আছেন। মনে হচ্ছে সূর্য শুধু তার দিকেই আলো দিচ্ছে। আর আমি পিছনে বৈঠা হাতে। সামনের দিকে মুখ করে হাত কপালের উপর দিয়ে বসে আছে যেন সূর্যের আলো চোখে না লাগে। হঠাৎ আমার দিকে ফিরলেন। এর কারণ খুঁজতে লাগলাম। পরে বুঝলাম সূর্যের আলো ডিস্টার্ব করছে। তাই আমার দিকে মুখ করে বসছে। এরই মাঝে বিলের প্রায় মাঝখানে চলে এসেছি। আমাদের নৌকার চারিদিকে লাল পদ্ম ফুলের সমাহার। পদ্ম পাতার ওপর জল বিন্দু আপন মনে খেলা করছে। সূর্যের আলোতে সেগুলো আবার চিকচিক করছে।

চলচল আর মিষ্টি মেয়ে। পদ্ম বিল দেখে আনন্দে আত্মহারা। অল্প সময়ে কত ভংগিমা দেখালো তার ইয়ত্তা নেই। গায়ে সাদা স্কার্ট। তার উপরে ডিপ ব্রাউন কালারের কোটি। তার হালকা ব্রাউন কালারের চুলগুলো হাতের দু পাশ দিয়ে বুকের উপর আছড়ে পড়ছে। একটু ঢিলা হাতা। বাম হাতে কালো রঙের ঘড়ি। গোলায় একটা ক্যামেরা ঝুলানো। মোবাইলের ক্যামেরায় সেলফি তুলতে ব্যস্ত। তার গালের ডান পাশের টোলের কারণে ছোট্ট তিলটা দেখা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে হাত দিয়ে পদ্ম পাতার জলবিন্দু সড়িয়ে দিচ্ছে। হাতের সাথে লাল পদ্ম ফুলের স্পর্শ নিতেই লাল হয়ে উঠছে। মাঝে মাঝে এক পা পানিতে ডুবাচ্ছে আবার তুলছে। তার পায়ের সাথে পানির স্রোতে এক অপূর্ব সুন্দর শব্দের সৃষ্টি হচ্ছে। এতে নৌকার গতিপথ পরিবর্তন হলেও খুব ভাল লাগছে। স্বচ্ছ পানিতে পায়ের লাল আলতা জ্বলজ্বল করছে।
হঠাৎ দেখলাম কোন এক অজানা কারণে তার মনটা খুবই খারাপ। আমার দিকে চেয়ে আছে। আমি বৈঠা বাইছি। হঠাৎ বৈঠার ৫ ফোটা পানি তার মুখের উপর পড়লো। শিহরিত হয়ে চমকে উঠলেন। জোরে এক নিঃশ্বাস নিলেন। আমি সরি বলতেই উনি বললেন- ঠিক আছে। আরে কি বলেন, আমার খুব ভাল লাগছে। এরকম আবার কখন করবেন? বিস্ময় নিয়ে বললাম- আরে, আজব তো, আমি কি ইচ্ছে করে করেছি নাকি! আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে ১ মিনিট ১৯ সেকেন্ড চেয়ে রইলেন। আমি খানিকটা লজ্জা পেয়ে চোখের পলক নামালাম। আবার ইশারা করে ডেকে বললেন- প্লিজ, ইচ্ছে করে হলেও মাঝে মাঝে এমনটা করবনে কিন্তু।
এরই মাঝে আকাশে মেঘ। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। হঠাৎ করেই হালকা বৃষ্টি শুরু হলো। খুব ভয় পাচ্ছে। বৃষ্টির ফোটা পানিতে পড়তেই টোপ টোপ শব্দ হচ্ছে। তার গাল বেয়ে পানি পড়ছে। আর চুলের ডোগায় বৃষ্টির পানি বিন্দু আকারে লেগে আছে। ব্যাগ থেকে ছাতা বের করলেন। ছাতা নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসতেই নৌকার এক পাশ ডুবে যাবার উপক্রম। উনি ভয়ে আবার নৌকার সামনের দিকে চলে গেলেন। এটা দেখে আমি বললাম- অকে, ঠিক আছে, আমার লাগবে না। আপনি একাই ছাতার নিচে থাকুন। ছাতা বের করে বসতেই বৃষ্টি থেমে গেলো।
তারপর দেখি মন খারাপ করে বসে আছে। মনের রাজ্যে মেঘের ছোয়া। জিজ্ঞেস করলাম – মন খারাপ কেন, কী হয়েছে? বললেন – আচ্ছা, চারিদিকে এত লাল পদ্ম দেখছি, নীল পদ্ম কি পাবো না? আমার না, নীল পদ্ম খুবই দরকার। হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন। আমার দিকে এগিয়ে আসলেন। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। দু জন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। খুব জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়ছেন। সেটা আমার শার্টের দুই নম্বর বোতামের পাশে খুব করে অনুভব করলাম। ভয়ে বারবার আতকে উঠছে। কিছুই বলতে পারছে না। কাপতে কাপতে হঠাৎ করে আমার হাত ধরলেন। তার দু হাত হাল্কা করে ধরে বসিয়ে দিয়ে বললাম- আরে বলেন না, কি হয়েছে, এমন করছেন কেন? আঙুল দিয়ে ইশারা করে দেখিয়ে বললেন- ওই যে দেখুন, ওখানে কী?

চোখ ফিরিয়ে দেখলাম এক বিশাল সাপ পদ্ম পাতার ওপর ফোনা তুলে আছে। পাশেই একটা পদ্ম। তার উপর কয়েকটা কালো ভোমর খেলা করছে।
লেখক- প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ।